English টিংলিশ

নতুন কোম্পানী জয়েন করার এক মাসের মধ্যেই একদিন হঠাৎ করেই বস এর আদেশ, আজ দুঘন্টা এক্সট্রা টাইম থাকতে হবে। তাও আবার নিজের কাজের জন্য নয়। অন্য একটি ডিপার্টমেন্টের প্রক্সি হিসেবে। যাইহোক আমি নতুন তাই হ্যা না জিজ্ঞাসা নয়, সোজা আদেশ। নিজের কাজের জন্য বরাদ্দ নয় ঘন্টা শেষ করে আমি সন্ধ্যে সাতটায় গেলাম সেই অন্য ডিপার্টমেন্টে। সেটি হলো কাউন্সিলিং রুম। ভর্তির জন্য যে স্টুডেন্ট বা গার্জেনরা আসেন তাদের কাউন্সিলিং এর দায়িত্ব আজ আমার।

স্বভাবতয় রাত সাতটা আটটার পর এই অংশের কাজের চাপ নেই বললেই চলে। কিন্তু, যেহেতু আজ আকস্মিক ভাবে সকলে অনুপস্থিত; তাই, বস ফায়ার করার সময় বন্দুকটা আমার কাঁধেই এডজাস্ট করলেন। এখানে আমি নতুন তাই আমার সাথে দেওয়া হল আর একজন সি-গ্রুপ স্টাফ। কাজের চাপ কম হওয়ায় আমরা নিজেদের নাম কি? কোথায় থাকেন? কোন ডিপার্টমেন্টের গল্প দিয়ে শুরু করে আস্তে আস্তে বেশ বন্ধুত্ব গোছের হয়ে গেল।

ভদ্রলোকের নাম দয়ারাম, বয়স হয়ে বড় জোর ৪৮/৫০, মাঝারি গড়ন, চোখে রিমলেস, কলপ করা চুল ও গোঁফ, আর ঠোঁটের কোণে সর্বক্ষণ একটা মৃদু হাসি। পড়নে হাফ সার্ট ও ফরমাল প্যান্ট। ওনার আদি বাড়ি পাটনায়, ছেলে বেলা আর লেখাপড়া সবই সেখানে, তাই ভাষাতে বাংলা ও হিন্দি মেশানো। কথায় কথায় উঠে এলো উনি কলকাতায় আছেন আজ ২৩ বছর। আর এই কোম্পানিতে প্রায় ১১ বছর। অচেনাবা সদ্য চেনা লোকের সাথে আমি সেভাবে কথা বলতে পারিনা। চ্যাট বা মেসেজে সরগর হলেও সামনে সামনি আলাপে আমি বলার চেয়ে শুনি একটু বেশি। তাই ওনার গল্প বলার পথ প্রশস্ত করতে জিজ্ঞাসা করলাম এর আগে কোথায় ছিলেন? উনি বললেন এর আগে অসংখ্য জায়গায় উনি কাজ করেছেন। ১৯ বছর বয়স থেকেই উনি বাইরে রয়েছেন। তার মধ্যেই একটি কোম্পানিতে উনি ছিলেন ৫ বছর। সেটি ছিল একটি কন্সট্রাকসন কোম্পানি। একথা সেকথা হতে হতে উনি বললেন সেখানে দয়ারাম যে কন্ট্রাক্টরের আন্ডারে সুপারভাইজর হিসেবে কাজ করতেন তার গল্পই বলব।

সেই ভদ্রলোকের নাম রাসেল গোমস। দেখতে ভীষণ কুৎসিত কিন্তু মুখ খুললে তাকে সাহেবের দেশের ভেবে যে কেউ ভুল করবে। অসাধারণ ইংলিশ একশন ও কথা বলার ভঙ্গি। গায়ের রং কালো, গলার আওয়াজ ও গঠন পুরুষালী। এক কথায় অফিসের সকলে বেশ মান্য করে চলতো। কোন এক সময় দয়ারাম ও রাসেল গোমস কে একসাথে যেতে হয় দিঘা। রাত ৯ টায় ধর্মতলা থেকে বাস। কথা মত বাস এ ওঠেন দুজনে। রাতে খাওয়া দাওয়ার পর রাসেল গোমস তার পকেট থেকে একটুকরো কাগজ দয়ারামের হাতে দেন, এবং বলেন পড়তে। দয়ারাম বেচারা ক্লাস ১২এর পর আর কলেজের চৌকাঠে পা দেননি, এদিকে আবার হিন্দি মিডিয়াম হওয়ায় ইংরেজিতেও বেশ কাঁচা। রাসেল বাবুর সামনে এমন প্রেসটিজ ইস্যুর সম্মুখীন হয়ে তিনি বলেন চোখে চশমা নেই, তাই তিনি যেন নিজেই পরে নেন। দয়ারাম লক্ষ্য করলেন রাসেল গোমস কেমন যেন অস্বাস্তিতে পরে গেলেন। তাকে হঠাৎ বিচলিত দেখে দয়ারাম প্রশ্ন করে বসলেন, কি ব্যাপার সাহেব? কি এত ভাবনার বিষয় হলো?

বেশ খানিকটা নিরবতার পর উত্তর এলো, “দয়া, তোমায় তাহলে আজ সব খুলে বলি। তুমি কতদূর লেখা-পড়া করেছো?” দয়ারাম জানায়, ক্লাস ১২ অব্দি এবং তারপর কলেজে ভর্তি হলেও আর পড়াশোনা হয়নি। একটি অত্যন্ত ক্লান্তি মেশান দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাসেল বাবু বললেন, “আমি কখনো স্কুলেই যায়নি, লেখাপড়া তো অনেক দূরের কথা”। দয়ারাম বাবু আকাশ থেকে পরলেন। তিনি ভাবলেন, রাসেল বাবু নিশ্চয়ই মজা করছে, আর তা না হলে এ হোল ওনার মদিরা পানের আফটার এফেক্ট। হেসে উরিয়ে দিতে চেষ্টা করে বিশেষ লাভ হলো না। কারন এই রাতদুপুরে ইয়ার্কি করবেন এমন মানুষ তিনি নন। রাসেল বাবু আধশোয়া সিটের উপর ভর দিয়ে উঠে বসলেন এবং বললেন, “তাহলে শোন দয়া, আমার বাবা মা দুজনেই কাজ করতেন কসবা ও মুকুন্দপুর লাগোয়া বাইপাসের ধারে একটি এঞ্জিও এর লজে। সেখানে গেলে বুঝবে, কলকাতার বুকে একটুকরো বিদেশ যেন। নানা দেশ থেকে নানান রকম পোশাক ও ভাষার মানুষ অর্থাৎ, ফরেনাররা উঠতেন এই লজটিতে। লজের ঠিক গা লাগোয়া স্টাফ কোয়াটারে থাকতাম আমরা। আমার জন্ম, বেরে ওঠা সবই সেখানে। ছেলে বেলা থেকেই বাবার হাতে হাতে কাজ শিখতে থাকি। ছোট বলে লজের অতিথি দের ঘরে ছিল আমার অবাধ বিচরণ। ছেলেবেলা থেকেই আমার চারপাশে নিজের মাতৃভাষার থেকে বেশি শুনেছি ইংলিশ। লজের গেস্ট দের সাথে কথা বলতে বলতে কিভাবে যেন আমি শিখে গেলাম ওদের ভাষা, এবং কথা বলার ধরনও, কিন্তু তুমি বিশ্বাস করবে নাকি জানিনা, আজ এতগুলো বছর পরও নিজের নাম সই করতে আমার হাত কাঁপে। কারণটা বোধহয় পেন ধরাটা আমি ঠিক মত শিখতে পারিনি। তবে পড়তে বা লিখতে না পারলেও কেবলমাত্র বলার জোরেই আজ আমি চাকুরীরত এবং রোজগারো যথেষ্ট করি। কেউ কখনো আমার কুয়ালিফিকেসন জানতেই চায়নি, এভাবেই কেটে গেলো অর্ধেক জীবন”।

একরকম হাঁ করে শুনলেন দয়ারাম। তিনি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছেন না, মেলাতে পারছেন না তার চেনা রাসেল গোমসকে। কারন, তার নজরে, এমনকি অফিসের প্রত্যাকটি স্টাফের নজরে রাসেল গোমস মানে ইংলিশ এর জাহাজ আর তিনি কিনা কখনো বই এর মুখই দেখেন নি। গল্পের শেষে ঘরির দিকে চেয়ে দেখি, প্রায় বেরনোর সময় হয়ে এসেছে। দয়ারাম বাবুর গল্প বলার অসাধারণ কৌশলে আমি কখন চলে গেছি সেই দিঘা যাওয়ার বাসে, যেন নিজের কানেই শুনেছি ওদের কথপকথন। শুনলাম, জানলাম, গল্প হলেও সত্যি সত্যি এমন মানুষ আছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *