কলকাতা থেকে মাত্র ২৫৭ কিমি দূরত্বে প্রাচীন মল্লভূমের রাজধানী ও মন্দিরের শহর বিষ্ণুপুর। ঘুরতে যাওয়ার প্ল্যান হয়ে গেলো একদম হুট করেই। সাথে সাথে ট্রেন টিকিট ও তারসাথে রাত্রিবাসের উপযুক্ত ব্যবস্থা। তারপর যাত্রা শুরু। এবার আমাদের বেড়ানোর কেন্দ্রবিন্দু হল শিল্প সংস্কৃতি ও সঙ্গীতের পীঠস্থান তথা প্রাচীন ইতিহাস আর উপকথার শহর বিষ্ণুপুর।
বিষ্ণুপুরে প্রায় ৬২ জন রাজা পর্যায়ক্রমে তাদের শাসনকাল অতিবাহিত করেছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিলেন আদি মল্ল, জগৎমল্ল, বীরহাম্বি,রঘুনাথ সিংহ প্রমুখ; সেই সময়ের মধ্যে অনেক গর্বের ইতিহাস রয়েছে। শেষ রাজা ছিলেন কালীপদ সিংহঠাকুর; দুর্গা মন্দিরের সন্নিকটে তাদের বংশধরেরা আজও বসবাস করেন। এই বাঁকুড়ার মেয়ে হলেন শ্রী শ্রী মা সারদা। সুতরাং এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে এই মাটি কতটা ধন্য। সম্প্রতি স্বপরিবারে কলকাতা থেকে মাত্র চার ঘন্টার ট্রেনে মন্দির নগরী বিষ্ণুপুর ভ্রমনে গিয়েছিলাম। বেশ কিছু দিন থেকেই আমাকে টেরাকোটার মন্দিরগুলি বেশ আকৃষ্ট করছিল। চতুর্দশ ও ষোড়শ শতকের প্রচুর মন্দির প্রধানত টেরাকোটা কারুকার্যখচিত বহু মন্দির ছড়িয়ে আছে বিষ্ণুপুর জুড়ে ।মল্লভূম রাজ্যের উত্থান পতন আরও কত রোমাঞ্চকর ঘটনার সাক্ষী এই বিষ্ণুপুর ।
যখন পৌছলাম তখন পশ্চিম দিগন্তে সূর্য আস্তে আস্তে হেলে পড়েছে । সমগ্র বনাঞ্চলে আসন্ন সন্ধ্যার পূর্বাভাস ফুটে উঠেছে। মালভূম, বীরভূ্ম, শরভূম, সেনভূম, ধলভূম, সামন্তভূম, শিখরভূম ও তুঙ্গভুম এই আটটি রাজ্য নিয়ে গড়ে উঠেছিলো সেদিনের মল্লভূম সাম্রাজ্য । আজও বিষ্ণুপুরের এখানে সেখানে ছড়িয়ে আছে অগণিত মন্দির । শহরটি তাই মন্দিরময় ।এইসব মান্দির মল্লরাজদের কীর্তি বহন করে চলেছে চতুর্দশ ও ষোড়শ শতকে এগুলি নির্মিত। মন্দিরগুলির গায়ে খোদাই করা শিল্পকীর্তি ও কারুকার্য দেখলে বিশ্মত হতে হয় । পোড়ামাটির ফলকে দেবদেবীর উপাখ্যান, তৎকালীন সমাজ জীবনের চিত্র ফুটে উঠেছে।বিষ্ণুপুরের অগণিত মন্দিরগুলির মধ্যে জোড় বাংলা শ্যামসুন্দর , মদনমোহন এবং রাধাশ্যাম মন্দির ছাড়া প্রায় প্রত্যেকটি মন্দিরের গঠন প্রণালী একই প্রকার। প্রত্যেক কটি মন্দিরের মাথায় কারুকার্য খচিত একটি করে চুড়া। পরদিন সকালে আমরা সকলে গেলাম মদনমোহন মন্দিরের পথে।
মদনমোহন_মন্দির:
মল্লরাজা দুর্জন সিংহ এই এক রত্ন মন্দিরটির প্রতিষ্ঠাতা । এর গায়ে কৃষ্ণের লীলা ও পৌরাণিক কাহিনী চিত্রিত আছে। এই স্থানে মদনমোহনের নিত্য সেবা, রাস ও দোল উৎসব অনুষ্ঠিত হয় এখানে। কেনাকাটার জন্য এর সামনে বেশ কয়েকটি দোকান পেয়ে যাবেন। দোকানগুলোর মধ্যে বিভিন্ন ধরনের মুখোশ দিয়ে সাজানো একটি দোকানে আমার দৃষ্টি আটকে যাচ্ছিল বার বার। এখানে সুলভ শৌচাগার এর সুবিধা পেয়ে যাবেন। শৌচাগারের কথা এল কারন আমি অন্যান্য দর্শনীয় স্থানে এটির ভীষণ অভাব অনুভব করেছিলাম। এর পর আমাদের গন্তব্য শ্যাম মন্দির।
শ্যমরায়_মন্দির:
টেরাকোটার কাজে সমৃদ্ধ , পোড়ামাটির ইট নির্মিত পঞ্চ রত্ন মন্দিরটি মল্লরাজা রঘুনাথ সিংহ প্রতিষ্ঠা করেন। এই মন্দিরের গায়ে মহাভারতের দৃশ্য চিত্রিত দেখা যায়।আমি শুধু অবাক হয়ে ভাবি যে এত নক্সা করতে কত সময় , পরিশ্রম ও ধৈর্য লেগেছিল শিল্পীদের!
রাসমঞ্চ বা ১০১ দুয়ারী:
মল্লরাজা বীরহাম্বি ১৬০০ খ্রিস্টাব্দে এই মঞ্চটি তৈরি করেন। এর নিচের বেদি মাকড়া পাথরের তৈরি, এক অভিনব পিরামিড আকৃতির স্থাপত্য, এর গায়ের যে প্লাস্টার আছে তাকে স্থানীয় ভাষায় “পঙ্খের প্রলেপ” বলে। এর আরেক নাম “১০১ দুয়ারী” কারন ১০১টি দুয়ার আছে কিন্ত দরজা/পাল্লা নেই!!
গুমগড়:
রাস্তায় যেতে যেতে আমাদের গারির চালক আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন এই স্তাপত্যর দিকে। উনি জানান মল্লরাজা বীরসিংহ এটি তৈরি করেছিলেন। উনি এটাও জানান এটি হয় রাজবাড়ির জলের ট্যাংক হিসাবে ব্যবহার হত অথবা এখানে অপরাধীদের এনে গুম করে দেওয়া হত, যেকোনো একটি ঠিক। এখানে দ্বিতীয় তথ্যটি গ্রহণ করলে মনে বেশ ভয়, রোমাঞ্চ হয় বলে অপরাধীদের শাস্তির তথ্যটি আমার ভালো লাগলো। নাহলে বর্গাকার ইঁটের তৈরি একটি ঘর বিশেষ ছাড়া আর কিছু নয় এটি।
মৃন্ময়ী_মন্দির: (দুর্গা মন্দির)
প্রথম দর্শনে এটিকে মন্দির বলে মনে হয় না, মনে হয় কোনো লাইব্রেরির সামনে এসে দাঁড়িয়েছি।
মল্লরাজা জগৎমল্ল ৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে দৈবাদেশ পেয়ে মন্দির ও মূর্তিটি প্রতিষ্ঠা করেন। দুর্গা মূর্তিটি গঙ্গামাটির তৈরি। এই মন্দিরের নিত্য পূজা হয়, মহাঅষ্টমীর সন্ধিক্ষণে তোপধ্বনি করা হয়, তবে তোপটা খুঁজে না পেলেও ওটি সজত্নে রাখা রয়েছে! দুপুরে ভোগ খাবার ব্যবস্থা আছে, তবে সময়ে নাম লেখাতে হবে। এই মন্দিরের গায়ে টেরাকোটার কাজ নেই! এই মন্দিরের পাশেই রাজবাড়ির ধ্বংসস্তুপ, “বিনা অনুমতিতে প্রবেশ নিষিদ্ধ” বোর্ড ঝুলানো। মন্দিরের সামনেও কেনাকাটা করার জন্য দোকান পেয়ে যাবেন। মন্দির প্রাঙ্গণে ঢুকতে ডান হাতে যে দোকানটি পরে সেটি বাকিগুলোর থেকে অপেক্ষাকৃত সস্তায় জিনিস দিচ্ছিল। তিনটি দোকানে বিস্তর দরাদরি করার পর যখন কিছু কিনবো বলে ঠিক করেছি তখনই ড্রাইভার দাদা পরিত্রাতা রূপে আবির্ভুত হয়ে এমন তারা লাগালো, কেনাকাটা ফেলে লাফ দিয়ে গারিতে গিয়ে বসে পড়লাম(আমার পয়সা বেঁচে গেল)। এর পর আমাদের গন্তব্য জর-বাংল।
জোড়বাংলা:
মল্লরাজা রঘুনাথ সিংহ এই অদ্ভুত দর্শন মন্দিরটি স্থাপন করেন। মন্দিরের গায়ে টেরাকোটার কাজের মাধ্যমে রামায়ন মহাভারতের বিভিন্ন দৃশ্য ফুটিয়ে তোলা আছে। খানিকক্ষণ পর্যবেক্ষণের পর মনে হল দুটি আলাদা মন্দিরকে পাঞ্চ করে তৈরি হয়েছে এই মন্দিরটি। বেশ আলাদা প্রশংসনীয় গঠণশৈলী। এর গায়ে যে টেরাকোটার কাজ দেখা যায় তা সবার থেকে আলাদা ভাবে নজর কাড়বে। এর সামনে অল্প কিছু অস্থায়ী দোকান বসে, তার মধ্যে কাঠের তৈরি বিভিন্ন দ্রব্য বেশ মনে ধরেছিল।
রাধাশ্যাম_মন্দির::
মল্লরাজা চৈতন্য সিংহ মাকড়া পাথরের এই মন্দিরটি ১৭৫৮ খ্রিস্টাব্দে নির্মাণ করেন। এই মন্দিরে রাধা-শ্যাম , নিতাই ও জগন্নাথ এর মূর্তি পূজিত হয়। মন্দিরের এক পাশে আছে তুলসী মঞ্চ,রান্না ঘর ও আরেক পাশে আছে নহবত খানা। নিতাই ও জগন্নাথ দেবের মূর্তি সোজা তাকালে দেখতে পাবেন না, মন্দিরের গর্ভগৃহের গ্রিলে আপনার মুখটি সেটে দিয়ে বাম দিকে তাকালে দেখতে পাবেন ওখানে রাখা আছে।
রাধালালজিউ_মন্দির:
মল্লরাজা বীরসিংহ, শ্রীরাধিকা ও কৃষ্ণের আনন্দের জন্য এই পাথরের মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে আমরাই এই মন্দির দেখে আনন্দ পাচ্ছি, এই মন্দিরে বিগ্রহ নেই, অন্য কোথাও স্থানান্তরিত করা হয়েছে। এই মন্দির দেখতে-দেখতে একটা কথা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল, এই স্থাপত্যগুলি কত বছর আগে নির্মাণ হয়েছে, কত প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্মুখীন হয়ে আজও স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে!
বড়_পাথরের_দরজা_ও_ছোট_পাথরের_দরজা ::
এই দুটি মাকড়া পাথরের দরজা তখনকার বিষ্ণু পুরের গুরুত্ব পূর্ণ তোরণ ছিল। এখন দেখে মনে হল, কলকাতায় এমন একটি যায়গা থাকলে আড্ডার আসর বসে যেত এর উপর।
দলমাদল_কামান:
শোনা যায় ১৭৪২ খ্রিস্টাব্দে বর্গী বাহিনী নগর আক্রমন করলে স্বয়ং রাধামাধব এই কামান থেকে গোলাবর্ষণ করেন এবং মল্ল ভূমি রক্ষা করেন। ছোটোবেলায় বাবার কোলে বসে এই দলমাদল কামানের গল্প শুনতাম, কেষ্ট ঠাকুর নিজেই এই কামান চালিয়েছিল! আজ দলমাদলের সামনে দাঁড়িয়ে সেই সময়ের কথা মনে পরে গেল, আর রোমাঞ্চে সর্বাঙ্গ কাঁটা দিয়ে উঠতে থাকল। বিশ্বাসই হচ্ছিল না আমি সেই কামানের সামনে দাঁড়িয়ে!বিশ্বাস-অবিশ্বাসের চোখ নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম কামানটির দিকে। ১৯১৯ সালে ব্রিটিশ সরকার সকলের দর্শনের জন্য কামানটিকে একটি বেদির উপর স্থাপন করেন।
শ্যামসুন্দর মন্দিরের কিছু মিথুন মুর্তি ছাড়া রামলীলা ও বিভন্ন নৃত্যের চিত্রশৈলী দেখতে পাওয়া যায় ।রাজ্য জগৎমল্ল প্রতিষ্ঠাত মৃন্ময়ী মন্দিরটি বিষ্ণুপুরের আদি মন্দির বলে জানা যায় । মল্লভূম রাজাদের প্রয় দু- হাজারের ওপর কামাছ ছিল।দলমাদল কামান তাদের অন্যতম। বীর হাম্বীরের আশ্চর্য কীর্তি রাসমঞ্চ । দূর থেকে পিরামিডের মত মনে হয় । এর গঠন নৈপুণ্য অন্যান্য মন্দিরের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা । রাসলীলা উৎসবের সময় অন্যান্য মন্দিরের শ্রীকৃষ্ণের বিগ্রহ এই স্থানে রাখা হতো । মল্লভূমের রাজা বীর হাম্বীর এর নির্মাতা বলে আছে । আজও বিষ্ণুপুরের অতীতে সাক্ষ্য বহন করে আছে সাতটি সুবৃহৎ বাঁধা লাল বাঁধ , কৃষ্ণ বাধ শ্যাম বাঁধ ও পোকা বাধঁ জলসেচের সুবিধার জন্য এইসব বাঁধ খনন করা হয়েছিল । বর্ষা ও প্লাবনের জল এইসব বাঁধগুলোয় ধরে রাখা হতো । বাঁধগুলোর মধ্যে লাল বাঁধ সর্ববৃহৎ ছিলো এবং এটি ইতিহাস প্রসিদ্ধ।
ভারতীয় সঙ্গীত চর্চায় বিষ্ণুপুর এক সময় বিশিষ্ট স্থান আধিকার করেছিলো । বিষ্ণুপুর ঘরানার জন্ম অষ্টদশ শতকের শুরু থেকে মল্লরাজ দ্বিতীয় রঘুনাথ সিংহ ছিলেন সঙ্গীতের উপাসক । রাজ্য পরিচালনার চেয়ে সঙ্গীতের প্রতি তাঁর আকর্ষণ ছিলো অপ্রতিরোধ্য । মল্লরাজ তার রাজসভায় তানসেন বংশধর ওস্তাদ বাহাদুল খাকে স্থান দিয়েছিলেন। দিল্লী থেকে পাখোয়াবাদক পীরবক্রাকেও নিয়ে এসেছিলেন তাঁর দরবারে ।বিষ্ণুপুর ঘরানার প্রতিষ্ঠাতা মল্লরাজ দ্বিতীয় রঘুনাথ সিংহ হলেও গদাধর চক্রবর্তী ও রামশস্কর ভট্রাচর্য ছিলেন এই ঘরানাকে যাঁরা শ্রেষ্ঠত্বের আসনে বছিয়েছিলেন তাদের অনেকের মধ্যে যদুভট্র থেকে রামপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায় পাখোয়ার শিল্পী নিত্যানন্দ গোস্বামী, মণিলাল নাগের নাম উল্লেখযোগ্য জনপ্রিয়। বিদেশের বাজারে এই শিল্পের চাহিদা আছে বিশেষ করে পোড়ামাটির ঘোড়া। অন্যান্য শিল্পের মধ্যে তাঁত শিল্প বিশেষ করে বিষ্ণুপরের বালুচরী শিল্প আজ বিশ্বজুড়ে খ্যাতি লাভ করেছে।
বিষ্ণুপর মল্লরাজ বংশের ইতিহাসের এক করুণ অধ্যায়ের কথা উল্লেখ না করলে এ লেখা অসম্পুর্ণ থেকে যাবে। ইতিহাস প্রসিদ্ধ লাল বাঁধের কথা আগেই বলেছি কারণ মল্লরাজ দ্বিতীয় রঘুনাথ সিংহ – র প্রেমিকা লালবাঈ – এর নামে এই বাঁধের নামকরণ হয়। সঙ্গীতপ্রেমী রঘুনাথ সিংহ মনেপ্রণে ভালোবেসেছিলেন মুসলমান নর্তকী লালবাঈকে। ভুলে গিয়েছিলেন রাজর্ধম। লালবাঈ- এর রূপ যৌবন তার রঘুনাথকে চন্দ্রপ্রভা কাছে থেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছিলো। চন্দ্রপ্রভা সে জ্বালা সহ্য করতে পারেননি। কোনো এক অসতর্ক মুহূর্তে চন্দ্রপ্রভার বিষাক্ত তীর এসে বেঁধে রঘুনাথের বুকে। রঘুনাথের মৃত্যুর পর লালবাঈকে লৌহশৃঙ্খলে আবদ্ধ করে লাল বাঁধের জলে ডুবিয়ে মারা হয়।
দুই দিনের ছোট্ট ভ্রমণ অভিজ্ঞতা ও এক বুক ভাললাগা নিয়ে ফিরে এলাম আমার ব্যাস্ত শহরে।