Visit to Cooch Behar | সে বার বিহার কোচবিহার
সেই ছেলে বেলা থেকেই দেখেছি নবমীর পুষ্পাঞ্জলি দিয়ে ফেরার ঠিক পর থেকেই মনটা কেন জানিনা ভারি হয়ে থাকে। এক আশ্চর্য অনুভূতি, যেন কি একটা হারিয়ে যাবে তার আশঙ্কা। সারাটা বছরের প্রতীক্ষা এই চারটে দিন, হুশ করে ফুরিয়ে যায়, ফিরতে হয় ফের রোজনামচায়। তবে বাঙালীদের পূজো শেষ হয়না পূজো ট্যুর ছাড়া যাকে বলে পোস্ট পূজা ভ্যাকেশন। তাই প্রতিবারের মত এইবারও নবমীর বিকালে আমরা বেরিয়ে পড়লাম অচেনাকে চিন্তে, আদেখা কে দেখতে।
ছেলেবেলা থেকেই দেখেছি আমার বাবা ভীষণ ভ্রমণ প্রিয়, সেই কল্যাণে আজ অব্ধি বেশ কিছু জায়গা আমাদের ঘোরাঘুরি সম্ভব হয়েছে। এই ছোট বড় ট্যুরের একটি বেশ বড়সড় গ্রুপও তাঁর আছে। বাবারা চার বন্ধু, তাদের চার অর্ধাঙ্গিনী ও কচিকাঁচারা। এই কচিকাঁচাদের দলে আমি অনায়াসেই শিং ভেঙ্গে বাছুর হয়ে মিশে যাই, কোনোরকম আপত্তি না করে। কারণ বাবার মত আমিও ঘুরুঘুরু প্রিয়।
এবারে আমাদের গন্তব্য কোচবিহার। এই কোচবিহারে রয়েছে ৫টি মহকুমা- কোচবিহার সদর, দিনহাটা, মাথাভাঙ্গা, মেখলিগঞ্জ আর তুফানগঞ্জ। তুফানগঞ্জের রসিক বিলের পাখিরালয় দেখলে তো ফিরে আসতে চাইবেন না। এই জেলার উত্তরে পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলা; দক্ষিণে বাংলাদেশের রংপুর বিভাগ; পূর্বে অসমের গোয়ালপাড়া জেলা এবং পশ্চিমে জলপাইগুড়ি জেলা ও বাংলাদেশের রংপুর বিভাগ অবস্থিত।
কীভাবে যাবেন? মূলত ট্রেন আপনাকে কোচবিহার পৌঁছতে সাহায্য করবে। শিয়ালদা থেকে আপনি বেশ কয়েকটি ট্রেন যেমন তিস্তা তোর্সা, কামরূপ, উত্তরবঙ্গ ট্রেন তো পাবেনই। এছাড়া মোটামুটি সমস্ত গুয়াহাটি গামী ট্রেনগুলি কোচবিহারের ওপর দিয়েই যায়। এছাড়া আপনি যদি প্লেনে আসতে চান তাহলে বাগডোগরাতে নেমে আপনাকে গাড়ি বুক করে বা বাসে করে কোচবিহার পৌঁছতে হবে। আমরা যাত্রা শুরু করেছি মুর্শিদাবাদ জেলার সদর শহর বহরমপুর থেকে। সেখান থেকে নর্থ বেঙ্গল ষ্টেট ট্রান্সপোর্ট এ সোজা পৌঁছে গেলাম কোচবিহার। দূরত্ব ৫০৬ কিমি, সময় যা লাগা উচিত, লাগলো তার থেকে ঢের বেশি। কারণ মাঝ রাস্তায় ঝড় বৃষ্টি এলো ভেঙ্গেচুরে।
গন্তব্যে যখন পৌঁছলাম তখন সকাল ৯টা। কোচবিহারে থাকার জন্য আপনি প্রচুর প্রাইভেট হোটেল পেয়ে যাবেন। এছাড়া গভর্নমেন্টের গেস্ট হাউস পেয়ে যাবেন। এগুলি ছাড়াও থাকার ভালো জায়গা হিসেবে জেলা পরিষদের অতিথি নিবাস এবং বেনফিশ দ্বারা চালিত টুরিস্ট কমপ্লেক্সও বেশ ভালো অপশন। এগুলি আগে থেকেই অনলাইনে বুক করে ফেলতে পারবেন আপনি। মোটামুটি ৬০০ থেকে ১০০০ টাকার মধ্যে থাকার মত ভালো হোটেল আপনি পেয়ে যাবেন। তবে এর থেকেও বেশী রেঞ্জের হোটেল বা টুরিস্ট লজও আপনি পেয়ে যাবেন। আমাদের আবাসন বুক ছিল আগে থেকেই। লজটির নাম ‘রয়্যাল প্যালেস’(সুনিতি রোড, কোচবিহার, পশ্চিমবঙ্গ- ৩৭৬১০১/ দূরভাষ- ০৩৫৮২-২২২-২১০)। ছিমছাম সাজানো পরিপাটি গেস্ট রুম, লম্বা করিডোর, দুপাশে দেওয়ালে নানাবিধ কারিগরি সজ্জা। অনুভব করলাম, মেঘ, বৃষ্টি, রোদ, ছায়া নিয়ে সারাক্ষণ কে যেন খেলা করে চলেছে অবিরত।
পথশ্রমে ক্লান্ত আমরা সকলেই যে যার রুমে গিয়ে প্রথমে স্নান ও প্রাতরাশ করে টানা একটা ঘুম দিয়ে যখন উঠলাম, তখন বেলা গড়িয়ে দুপুর। ঠিক ছিল দুপুরের খাওয়া সেরে আমরা যাব কোচবিহার রাজবাড়ির উদ্দ্যেসে।
★কোচবিহার রাজবাড়ি (অপর নাম ভিক্টর জুবিলি প্যালেস)★
বাসস্ট্যান্ড থেকে লজে রিকশা করে যাওয়ার পথেই কোচবিহার প্যালেস নজরে পড়লো, এটাই শহরের মূল মনচোরা। প্রাথমিক দৃষ্টিতে তার সৌন্দর্য ও বিশালতা দেখে বুঝলুম, পুরো বিকেলটাও না কম পড়ে।। এমনিতে কোচবিহার উত্তরবঙ্গের একমাত্র পরিকল্পিত শহর যার আবার রয়েছে হেরিটেজ তকমা। কোচবিহার জেলার মূল আকর্ষণ কিন্তু এই রাজবাড়ি। ইংল্যান্ডের বাকিংহাম প্যালেসের অনুকরণে তৈরী এই বিশাল রাজবাড়ি কিন্তু আজও রাজবাড়ির জাঁকজমকের সাক্ষ্য বহন করে। মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণের আমলে এই রাজপ্রাসাদ তৈরী হয়। এটি পুরোপুরি ঘুরে দেখতে কিন্তু অন্তত ২-৩ ঘন্টা সময় লাগবে। এর সাথে লাগোয়া মিউজিয়াম কিন্তু মিস করা চলবে না। এছাড়া সন্ধ্যে বেলায় বেশ সুন্দর একটি লাইট অ্যান্ড সাউন্ড প্রোগ্রামের আয়োজন করা হয়। মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণের রাজত্বকালে লন্ডনের বাকিংহাম প্রাসাদের আদলে এই রাজবাড়িটি তৈরি হয়েছিল।
কোচবিহার রাজবাড়ি ইষ্টক-নির্মিত। ভবনের কেন্দ্রে একটি সুসজ্জিত ১২৪ ফুট (৩৮ মি) উঁচু ও রেনেসাঁ শৈলীতে নির্মিত দরবার হল রয়েছে। এছাড়া বাড়িতে রয়েছে ড্রেসিং রুম, শয়নকক্ষ, বৈঠকখানা, ডাইনিং হল, বিলিয়ার্ড হল, গ্রন্থাগার, তোষাখানা, লেডিজ গ্যালারি ও ভেস্টিবিউল। যদিও এই সব ঘরে রাখা আসবাব ও অন্যান্য সামগ্রী এখন হারিয়ে গিয়েছে।
সারাটা বিকেল অনায়াসে পার করে যখন সন্ধ্যে প্রায় নেমে এসেছে পৃথিবীর খুব কাছা কাছি, আমরা গেলাম কোচবিহারের অন্য আর একটি প্রধান আকর্ষণ।
★মদনমোহন মন্দির★
বিগ্রহটি কোচবিহার মহারাজাদের গৃহদেবতা। মন্দির প্রকোষ্ঠে রুপোর তৈরি মঞ্চ এবং মঞ্চের উপর রুপোর সিংহাসনে অলংকারে ভূষিত অষ্টধাতুর মদনমোহন বিগ্রহ। চার কক্ষবিশিষ্ট মন্দিরটির প্রতিটিই কক্ষেই দেবদেবীর অবস্থান লক্ষ করা যায়। এদের মধ্যে সবচেয়ে বড় কক্ষে মদনমোহন বিগ্রহটি অধিষ্ঠান করছেন। এই কক্ষটির ওপরে সোনালি রঙের গম্বুজ, গম্বুজের মাথায় পদ্ম, কলস, আমলক ইত্যাদি শোভা পাচ্ছে। এখানে রাসযাত্রা উপলক্ষে দশদিন ধরে সাড়ম্বরে পূজা, ভোগ, ইত্যাদি অনুষ্ঠিত হয়। ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি থেমে তখন হাওয়া বয়ছে আলতো করে। মন্দিরের প্রবেশ দ্বারের ঠিক সামনে রয়েছে একটি বেদি। সুন্দর আল্পনা দিয়ে সাজানো বেদিতে বসে সকলে ছবি নিলাম, তারপর ফেরার পালা।
আজকের মত বিশ্রাম, যাত্রা আবার আগামী কাল।
পরদিন ঘুম ভাঙলো বেশ তাড়াতাড়ি। আজকের গন্তব্য –
★বাণেশ্বর শিবমন্দির★
কোচবিহারের বিখ্যাত মন্দিরগুলির মধ্যে বাণেশ্বর শিবমন্দির অন্যতম। মন্দিরটির প্রতিষ্ঠাকাল নিয়ে নানা মতবাদ চালু আছে। কেউ বলেন বাণরাজা কেউ বলেন রাজা জল্পেশ মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন। তবে পরবর্তী সময়ে মহারাজা প্রাণনারায়ণই ইটের প্রাচীর ঘিরে মন্দিরটি সংস্কার করেছিলেন। কিংবদন্তি অনুসারে দৈত্যরাজ বাণাসুর বাহুবলে স্বর্গরাজ্য অধিকার করে দেবতাদের তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। বাণাসুর ছিলেন শিবের একনিষ্ঠ ভক্ত। দেবতাদের দুর্দশা দেখে শিব বাণাসুরকে নির্দেশ দিয়েছিলেন স্বর্গরাজ্য দেবতাদের ফিরিয়ে দিতে। বাণাসুর একটি শর্তে স্বর্গরাজ্য ফিরিয়ে দিতে সম্মত হয়েছিলেন। সেটি হল যদি তাঁর উপাস্য দেবতা এই স্থানে অধিষ্ঠান করেন। সেই সময় থেকেই বাণেশ্বর শিবের প্রতিষ্ঠা।
মন্দির পেলেই দেখেছি মা এবং বাবা আশ্চর্য রকম ভক্তিবান হয়ে ওঠেন। এবারেও কোন পার্থক্য নেই। তার উপর যুক্ত হল সকাল বেলা, মঙ্গল বার এবং আমরা তখনো প্রাতরাশ করিনি। কাজেই ঠিক হোল হইহই করে সকলে মিলে পুজ দেওয়া হবে। মস্ত লাইন পেরিয়ে যখন গর্ভ-গৃহে ঢুকলাম, দেখলাম মহাদেব রীতিমত একবুক জলে অধিষ্ঠিত। মন্দিরের বাইরে রয়েছে এক বিশাল দিঘী, আর তাতে রয়েছে বেশ কিছু বৃহৎ আয়তনের কচ্ছপ। আমরা ফল, বাদাম খাইয়ে তারসাথে খেলা ধুলো সেরে বাইরে এসে নানান জায়গায় দাঁড়িয়ে নানা ভঙ্গীতে সকলে মিলে ছবি নিলাম এবং তারপর ক্লান্ত হয়ে চললাম দুপুরের ভোজন সারতে।
আমাদের পরবর্তী গন্তব্য !!!
★সাগর দিঘী★
এই অদ্ভূত জলাশয়টির চারদিকের চারটি ঘাট যেন এই সম্পদটির চারটি কঠিন শক্তিশালী প্রহরী , যারা এই ঘাটটিকে আষ্টে-পৃষ্টে রক্ষা করছে। দীঘির পশ্চিম দিকের প্রাচীনতম শিব মন্দিরটি এই স্থানটিকে দৈব বাতাবরণে ভরে তোলে। সাগর দীঘি কোচবিহারের সেই স্নেহপ্রবন হৃদপিন্ড, যাকে ছাড়া কোচবিহার কেবল ইঁট-কাঠ-পাথরের তৈরী প্রাণহীন একটি শহর, যাতে প্রাণসঞ্চার করে এর মাঝখানের এই তুলনাহীন সাগর দীঘি। এই দীঘিটিই দিনের চারটি সময়ে চার রকম বিভিন্ন অপরূপ সাজে সেজে ওঠে। সূর্যাস্ত হতে না হতেই সুর্যের শেষ কিরণ এই জলের ওপর ঝলক দিয়ে ওঠে আর সঙ্গেসঙ্গে প্রত্যেকটি স্তম্ভে বেজে ওঠে শান্তিময় সুরে মাখা রবীন্দ্র সংগীত।এর চার দিকে অবস্থিত কর্ম স্থান গুলির আলো এই দীঘির জল কে আলোকিত করে তুলতে কোন ত্রুটি রাখে না। তখন এই রাতের সাগর দীঘি যেন আরো মায়াবী হয়ে ওঠে।
শীতে এই সাগর দীঘির আরো একটি বৈশিষ্ট্য এর রূপ কে আরও মোহময় করে তলে। ঠিক মধ্য শীতের কুয়াশায় চোখে পরে এর জলের ওপর অজস্র পরিযায়ী পাখিদের সমাবেশ।
এবার দিন শেষে ঘরে ফেরার পালা। কাল আমাদের গন্তব্য জলদাপাড়া। কোচবিহার শহরটি ১ দিন বা ১/২ দিনের মধ্যেই আপনি ঘুরে ফেলতে পারবেন। আর হাতে যদি আর একটু সময় থাকে তাহলে কিন্তু অনায়াসে ঘুরে আসতে পারেন জলদাপাড়া জঙ্গল বা রাজাভাতখাওয়া জঙ্গল। আর চাইলে একরাত কিন্তু জঙ্গলেও কাটাতে পারেন। এর সাথে কিন্তু করে ফেলতে পারেন বেশ রোমাঞ্চকর জঙ্গল সাফারি, তাও আবার হাতির পিঠে চড়ে। এই দুটি জায়গাতেই আপনি অজস্র টুরিস্ট লজ এবং জঙ্গলের ভেতরে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের টুরিস্ট লজ আছে যা আপনি অনলাইনে সহজেই বুক করে ফেলতে পারবেন এবং সেখানেই আপনি এলিফ্যান্ট সাফারির জন্যও বুকিং করে ফেলতে পারবেন। মোটামুটি ৬০০ টাকা লাগবে একেক জনের জন্য এলিফ্যান্ট সাফারিতে। আর জীপ্ সাফারি করতে চাইলে পার জীপ ১০০০ টাকা থেকে ১৫০০ টাকার মত লাগবে। থাকার খরচ কিন্তু মোটামুটি ১০০০ টাকা থেকে শুরু করে ৩০০০ বা ৪০০০ টাকা মত লাগবে এক এক দিনের জন্য।
সব মিলিয়ে আপনার এই ছোট্ট ট্যুর কিন্তু বেশ জমজমাট হবে। সবুজ অরণ্য এবং সুন্দর শান্ত ছোট্ট একটি শহর কিন্তু আপনাকে হতাশ করবে না। তাই চটপট ব্যাগপ্যাক রেডি করে ফেলুন বেড়িয়ে পড়ার জন্য।