একা থাকলে সাধারণত আমি বিভূতিভূষণ ও শরৎচন্দ্র পড়তে একটু ভয় পায়। কারণ পড়ার পর হাপুস নয়নে দিক ভ্রান্ত হয়ে সারাদিন কাটানো খুব কঠিন। তার থেকে বরং তারাদাস বা শীর্ষেন্দু ঢের ভালো। ছুটির দিন কাজ কম্ম করে খাওয়া দাওয়া, দুপুরের একটা ভাত ঘুম, ঘুম থেকে উঠে একটু পড়তে ইচ্ছে হলো। একটা বই নামিয়ে বসলাম। তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায় এর ‘তারিণী মাঝি’।
গল্প চলল বেশ সুন্দর ভাবে, পড়তে পড়তে আমার মুর্শিদাবাদ এর বেশ কিছু গ্রাম্য চেনা শব্দ পাচ্ছিলাম। গল্পের প্রধান চরিত্র তারিনী দীর্ঘ দেহ, পেশায় মাঝি, অত্যন্ত সৎ, কর্মঠ এবং নিস্বন্তান। স্ত্রী সুখী কে নিয়ে দুজনের ভারী মিষ্টি সংসার। বউ কে সে ভীষণ ভালোবাসে। ময়ূরাক্ষীর বুকে খেয়া পারাপার করে তার দিন চলে। আর মাঝে মধ্যে ডুবে যাওয়া মানুষ উদ্ধার করে কিছু পয়সা , জামা কাপড় এসমস্ত জুটত।
ময়ূরাক্ষী বছরের সাত মাস থেকে শুকনো খটখটে, বালির চড়ে মানুষ একরকম হেটেই পারাপার করে।বাকি তিন মাস থাকে তার ভয়ঙ্কর রূপ। এই তিন মাস নদীর উপর নির্ভয়ে খেয়া টানে তারিনী।
গল্পের মধ্যে ভাগে আসে চরম খরা ও দুর্ভিক্ষ। নদী নালা শুকনো, গ্রাম থেকে গ্রাম উঠে যাচ্ছে শহরে ,ভিক্ষে করে একমুঠো খাদ্যের সন্ধানে। শেষ অব্দি তারিণীও বউ সুখী কে নিয়ে বেরিয়ে পরে কিন্তু তাদের ফিরতে হয়। তারিণীর আবহাওয়ার সম্মন্ধে আগাম আন্দাজ যেখানে সে মনে করে খেয়া মাঝির পর্যবেক্ষণ কখন ভুল হয়না, তাই হয়। আকাশ ফাটা রোদ হটাৎ রাশিরাশি মেঘে রূপান্তরিত হয়। ময়ূরাক্ষী ফুলে ফেঁপে ওঠে। তারিণীর আনন্দ যেন ধরেনা। কিন্তু সে আনন্দর রেশ কাটতে না কাটতেই হল এক ভীষণ বিপদ , এক রকম হটাৎ করে হরপা বান আসে আর ভাসিয়ে নিয়ে যায় গোটা গ্রাম। তারিনী সুখী ও বাদ পড়েনা। সুখী কে তারিনী তার পিঠে উঠতে বলে ,এবং স্রোতের তোরে ভেসে যেতে থাকে, সে এক অনন্ত স্রোত, সময় যেন দিন মাস বছর অতিক্রম করছে। এক সময় তারা ঘূর্ণি স্রোতের মাঝে পরে। প্রানপন চেষ্টা করে সেখান থেকে বেরিয়ে আসার কিন্তু বাঁধ সাধে সুখী। সে যেন ভীষণ ভারী হয়ে গেছে। দু বাহু দিয়ে সে তারিনী কে আঁকড়ে বাঁচতে চাইছে। কিন্তু প্রকৃতির সহজাত নিয়ম যেমন করেই হোক নিজের প্রাণ রক্ষা করতে প্রানের থেকেও প্রিয় স্ত্রী সুখীর গলা টিপে শ্বাস রোধ করে তার বহু পাশ থেকে নিজেকে মুক্ত করে তারিনী, তারপর বুক ভরে বাতাস টানে। যে সুখী ছিল তার ধ্যান জ্ঞান, যার আনন্দ বিধানের জন্য যে মানুষের পরিহাস বিদ্রুপ গায়ে মাখেনি, রাত-দুপুরে মাতাল হয়ে ঘরে ফিরেও যে সুখীর গায়ে হাত তোলেনি,বরং তাকে নিয়ে গান গেয়ে গয়না পরিয়ে আল্লাদ করেছে- সেই তারিনীর নিজের প্রাণ টুকু রক্ষা করার সহজাত প্রবণতার পথে সুখী সব থেকে বড় প্রতিবন্ধ্ হয়ে দাঁড়াল,এবং তারিনী তাকে হত্যা করল। প্রেম-নারী- সংসার-গৃহ-দাম্পত্য সমস্ত কিছু সেই ভয়াল মৃত্যুর বিভীষিকার সামনে হারিয়ে গেছে। অবশিষ্ট থাকলো কেবল ব্যাকুল জীবনাতি টুকুই।
আমার মন ভারী হোল ।